মাহদি হাসান (IEM 14) এর ঘটনা
আমি মাহদি হাসান আইপিই-১৪। আপনাদেরকে আমার গল্প বলব, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প। আমার গল্পটা ভিন্ন, পাশ করে যাওয়ার পরেও সবাই যেমন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে সুখ অনুভব করে, আমি তা করতে পারব না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নির্যাতন, আতঙ্ক আর সহপাঠীদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা এক সৌভাগ্যবানের(!) গল্প।
ঘটনা পর্ব-১ম
২০১৭ সালের ১লা মে এর রাত। তারিখটা আমার বেশ মনে আছে। পরের দিন আমার পরীক্ষা ছিল। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভাঙল রাত সাড়ে বারোটার দিকে। আইপিই ১৫ ব্যাচের রাহুল, তাশদীদসহ মোট চার জন এসে আমাকে ডেকে নিয়ে যায় হলের গেস্ট রুমে। গেস্ট রুমে যেয়ে দেখলাম সেখানে আমার পরিচিত দুইজন সিনিয়র নাইম ভাই এবং রুম্মন ভাইকেও ধরে নিয়ে আসা হয়েছে।
দৌলতপুরে একটা কোচিং সেন্টারে একসাথে পড়াতাম আমরা। পরে জানতে পারি ঐ কোচিং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবার নাম দৌলতপুর থানার ওসি এস এম আনোয়ার হোসেন শিবির সন্দেহভাজন হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টার এর কাছে জমা দেয়। তখন রেজিস্টার ছিলেন ড. মোঃ শহিদুল ইসলাম এবং ভিসি ছিলেন আলমগির। রেজিস্টার তখন লিস্টটা কুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি এর কাছে দেয়। ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল মেকানিকাল ০৮ ব্যাচের সাফায়েত নয়ন।
বুঝতে পারছিলাম জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ বিভীষিকাময় দীর্ঘ একটি রাত পার করতে যাচ্ছি আমি। আমি চেষ্টা করছিলাম সাহস রাখার। শুরু হল জেরা-
শুরুটা করে আমি নাইম ভাইকে কিভাবে চিনি এই প্রশ্ন দিয়ে। ঠিক তার পরপরই IEM-১৪ এর সামিউর রহমান এবং BECM-১৩ এর তারেক নাইম ভাইকে বেধড়ক পিটাতে থাকে। অসহায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেখা ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। মনে হচ্ছিল এক পাল হায়েনা তার শিকারের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। সদা হাস্যোজ্জ্বল নাইম ভাই তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।
কিন্তু তারপর ও থামে না ওদের নিষ্ঠুরতা। অবশেষে নাইম ভাইয়ের মাথা ফেটে রক্তের ফিনকি বের হলে তারা নাইম ভাইয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে আমাদের দিকে নজর দেয়। আমার উপর নির্যাতন শুরু হয় কুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সিএসই ১৩ ব্যাচের সাদমান নাহিয়ান সেজানের দ্বারা।
সেজান সেদিন তার হিংস্রতার সবটুকু দিয়ে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়েছিল। এলোপাতাড়ি চড় ঘুষি তো ছিলই, সেই সাথে লাঠি, স্ট্যাম্প ও রড দিয়ে আমাকে বেধড়ক পেটাচ্ছিল। পিটাতে পিটাতে ক্লান্ত হয়ে বিরতি দিয়ে সে আবার মার শুরু করতো। আমার সারা শরীর ব্যাথায় কুকড়ে যাচ্ছিল। সাথে তারেক (BECM’ 13), দুর্জয় (IEM’14) আর ফয়সাল (IEM’15) আমার পায়ে নির্দয়ভাবে আঘাত করছিল।
আমার পায়ের আঙ্গুলের নখ খুলে চলে আসে। আমার মনে হচ্ছিলো আমি আর কোনোদিন পায়ের উপর ভর করে হাঁটতে পারব না। তারা আমার মুখেও চড় ঘুষি মারছিল। যার ফলশ্রুতিতে আমি চোখে আঘাত পাই; যেই আঘাত এখন ও আমাকে ভুগাচ্ছে। আমি ভাবছিলাম তাদের এই অত্যাচার কি আদৌ শেষ হবে নাকি তার আগেই আমি আমার আল্লাহর কাছে পৌঁছে যাব।
অবশেষে সেই দীর্ঘ কঠিন রাত শেষ হয়। আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া যে আমি তখনও বেচে ছিলাম।
সেই রাতে আমার মত আরও অনেকের উপর এমন অমানবিক নির্যাতনের খড়গ নেমে এসেছিল। আমার ব্যাচের আরও তিনজন ছিল। সকলেরই অবস্থাই বেশ খারাপ ছিল। এর মধ্যে ইউ আর পি-১৪ এর লুতফর রহমানের উপর হওয়া পাশবিক নির্যাতনের জন্য তার দুইটা কিডনিই প্রায় ড্যামেজ হয়ে যায়। এমনকি তার বেচে থাকা নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়।
সকাল বেলায় পুলিশের হাতে আমাদেরকে হস্তান্তর করে দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের হাত থেকে মুক্ত হয়ে পুলিশের হাতে আমাদের বন্দী হতে হয়। অথচ নির্যাতনকারীরা ছিল বহাল তবিয়তে। তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যোগাযোগ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পিতৃতুল্য শিক্ষকেরা নির্যাতনের সহযোগী হয়ে আমাদের মত নির্যাতিতের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
সেদিন বিভিন্ন হল থেকে মোট চৌদ্দ জনকে খান জাহান আলী থানাতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ছাত্রলীগের নির্যাতনের পরে আমরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরও স্বীকার হই। আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। একমাস খুলনা কারাগারে থাকার পরে আমার জামিন হয়। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে আনঅফিসিয়ালি বহিষ্কার করা হয়।
এরপর থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন আর কখনোই আগের মত ছিল না। আমার চেনা বিশ্ববিদ্যালয়টা আমার কাছে অপরিচিত হয়ে গেল, নিজেকে মনে হতো আগন্তুক। ক্যাম্পাসে থাকতে ভয় লাগতো, কোনো রকমে পরীক্ষা এবং ল্যাব দিয়েই চলে আসতাম। তাই আমার পক্ষে পড়াশোনাতেও আর ভাল করা সম্ভব হয় নি।
ঘটনা পর্ব-২য়
২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি আমি আবারও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের শিকার হই। ক্যাম্পাসে যখন ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়ার সময় হতো তখন তৎপরতা দেখানোর জন্য, আবার কখনও বা নিজেদের অন্তঃকোন্দল ধামাচাপা দিতে ওরা এরকম কাউকে টার্গেট করে অত্যাচার করতো।
সাদমান নাহিয়ান সেজান ততদিনে কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে গিয়েছে। সেই সব থেকে বেশি অত্যাচার করে এবং তার সাথে যোগ দেয় তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি সিভিল ১০ এর শোভন। এখন সে সরকারি চাকরি করে সহকারী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এল জি ই ডি তে আছেন। আরো ছিল নিবিড় BME-14, দুর্জয় ,সামি যারা আমার বিভাগেরই ছিল এবং আশিকুর রহমান শোভন ইইই ১৩ আমাকে এরাই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে।
আমাকে এবং শাহীন (আইপিই-১৪) কে ১৫ ব্যাচের রাহুল এবং তাশদীদ, ফয়সাল এবং দুর্জয় ১৪ আই পি ই সহ কয়েকজন মিলে ক্লাস থেকে ধরে নিয়ে যায়। যার নেতৃত্বে ছিল দুর্জয় ১৪ আই পি ই। একটা ক্লাস শেষ করে আমরা অন্য একটা ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এখনো ক্লাসের উপস্থিতিতে নামও রয়েছে ।
আমাদের দুজনকে নিয়ে বংগবন্ধু হলের ৩০১ নং রুমে নিয়ে যায়। সেখানে আমরা পৌঁছে দেখি আমার পরিচিত এক সিনিয়র আল আমিন ইইই-১৩ ভাইয়ের উপরে অত্যাচার চলছে। তারা আল আমিন ভাইকে গামছা দিয়ে চোখমুখ বেঁধে মারছিল। তারা আলামিন ভাইকে ক্রমাগত পায়ে এমনভাবে প্রহার করছিল যেন চিরদিনের জন্য পঙ্গু না করে থামবে না। সে সময়ে নিবিড় রেজা, সাজ্জাদ আইপিই ১৪ এবং আরো অনেকে ছিল যাদের সবার নাম মনে নেই। নিবিড় রেজা ছিল আমার ব্যাচেরই বিইসিএম ডিপার্টমেন্টের।
কিছুক্ষন পরই আমার পালা আসে। বিভিন্ন বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় জেরা আর অত্যাচার শুরু হয়। জেরার থেকে অত্যাচারের প্রতিই তাদের আগ্রহ ছিল বেশি। এবারেও আগের বারের মত ভয়ঙ্করভাবে পেটায় আমাকে। মানুষ বোধ হয় সাপকেও এত ভয়ঙ্করভাবে মারে না। অত্যাচারের একপর্যায়ে দুর্জয় ১৪ আইপিই আমার মাথায় আঘাত করলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই এবং সেবারের মত রক্ষা পাই।
কিছু পর গেস্ট রুমে নিজেকে আবিস্কার করলাম, অতঃপর আবার পুলিশ, থানা, গারদ, জেল-হাজত, কোর্ট, মামলা মোকাদ্দমা। এবারে আমাদেরকে অস্ত্র মামলা দেওয়া হয় যদিও আমাদের কাছে কোন অস্ত্রই ছিল না। ছাত্রলীগের ওরা কিছু অস্ত্র পুলিশের হাতে দিয়ে বলে যে ওগুলো আমাদের থেকে পাওয়া গেছে যা ছিল পুরোপুরি মিথ্যা, অথচ ওরাই আমাদেরকে ক্লাস থেকে ধরে এনেছিল। এমনকি ক্লাসের এটেনডেন্ট শীটে আমাদের উপস্থিতি উল্লেখ ছিল এবং আমরা বাকি ক্লাসগুলো আর করতে পারি নি। পুলিশও জানতো যে অস্ত্র আর বুলেটগুলো ছাত্রলীগের ওদেরই।
তখন কুয়েট প্রশাসন বা থানা পুলিশ সবই চলতো ছাত্রলীগের কথা মতো। যদিও এই মামলাটা পরবর্তীতে আদালতে খারিজ হয়ে যায়। এই মামলার সাক্ষী হয় সেজান সি এস ই ১৩, সোহানন বি ইসি এম-১৩, নিবিড় রেজা বি ইসি এম-১৪ এবং ১৩ ব্যাচের আশিকুর রহমান শোভন ই ই ই। এবারের মামলায় এক মাস দশ দিন পরে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পাই আমি। রিমান্ড ও হয় ১দিন এই মামলায়।
সেবার দুর্জয় আমার মোবাইল ফোনটা নিয়ে যায় যেটা আমার খালা ইটালি থেকে আমার জন্য গিফট পাঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার নির্যাতনের পরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন আমার জন্য আরও কঠিন হয়ে যায়। সবসময়ই একটা আতঙ্ক কাজ করত। ততদিনে বাবা মারা যাওয়ায় এবং পরিবারের একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়ায় পরিবারের আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠি আমি। আমার উপরে দুই বার এমন নির্মম অত্যাচার হওয়ায় আমার পরিবারও একদম ভেঙ্গে পড়ে। আমার মা অপেক্ষায় থাকতেন কবে কুয়েট নামের এই ‘নরক’ থেকে আমি পাশ করে বের হবো।
ঘটনা পর্ব-৩য়
কিন্তু আমার উপরে ছাত্রলীগের ক্ষোভ তবু শেষ হয় না। শিক্ষা জীবনের ইতি টানার আগে আমাকে আরো একবার অত্যাচার এবং মামলার শিকার হতে হয়। ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে আমি অনেক কষ্টে শিক্ষা জীবন শেষ দিকে নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন (১০ মার্চ) ছিল আমার চূড়ান্ত বর্ষের রিসিপশন। আগের দেওয়া অস্ত্র মামলায় মিথ্যা সাক্ষী দিতে গিয়ে আমার আইনজীবীর হাতে নাজেহাল হওয়ার কারণে ছাত্রলীগের সেজান ও আশিকুর রহমান শোভন আমার উপরে ক্ষেপে যায়। ক্ষোভ থেকে আমাকে আবারো টার্গেট করে। আমি যখন অডিটোরিয়াম থেকে নামছিলাম তখন ওরা আমাকে ধরে এবং সেখান থেকে রশিদ হলের দোতলায় নিয়ে যায়।
এইবার সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করে ১৪ ব্যাচের তিলক। পুলিশ আসার আগ পর্জন্ত গরম পানি ঢালা হয় ফজলুল হক হলের টিভি রুমে নিয়ে চোখ মুখ হাতে ব্যাপক আঘাত করা আমার বাম চোখ নস্ট হওয়ার হয়ে যাবে মনে হচ্ছিল। আর শাহিনের ১টা কিডনি নস্ট হয়ে যায় দির্ঘদিন আবু নাসের মেডিকেল এ ভর্তি ছিল তিলক,সেজান ১৩ সি এস ই, জামান ইব্রাহিম সি এস ই ১৪, সাথে আরও অনেক অজ্ঞান থাকায় মনে নেই পরে ওরা যখন আমাদেরকে মারছিলো, সেখানে ইকোনোমিক্সের লেকচারার শাহরিয়ার রোমান এবং আমারই ডিপার্টমেন্টের একজন আমার এক ব্যাচ সিনিয়র শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন পলাশ সাহা ১৩ ব্যাচ আই পি ই।
তারা আমাদেরকে রক্ষা না করে উপরন্ত বলছিলেন, এভাবে মারিস না, কোন সমস্যা হয়ে গেলে বিপদে পড়ে যেতে হবে। আমি রেজা,শাহিন এক ই ব্যাচের ৩ জন ফেয়ার ওয়েল থেকে নিয়ে মারে পরে মেহেদি (১৭ ব্যাচের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং) কে মারার পর পুলিশে দেয় ।
পরিশেষে আবার পুলিশ, থানা, গারদ, জেল-হাজত, কোর্ট, মামলা মোকাদ্দমা। ১০ দিন জেলের ৬ দিন ই খুলনা মেডিকেল এ ভর্তি ছিলাম ।পরে মামলা টা খারিজ হয়ে যায়।
হ্যা, এটাই আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প, কুয়েট নামের ‘টর্চার সেলে’ চার বছর কাটানোর গল্প। সেখানে চাইলেই কাউকে বেধড়ক পিটিয়ে, মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করা যায়; আবার নির্যাতনকারীরা হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সমান্তরাল আরেক প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বন্ধু, শিক্ষকের সহানুভূতি ও সহযোগিতা পেয়েছি কিন্তু সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের কাছে তারাও অসহায়ত্ব প্রকাশ করতো। কিছু ভালো স্মৃতিও আছে তাদের সাথে।
কিন্তু সেই স্মৃতিগুলো ঢেকে গিয়েছে আতঙ্ক ও নির্যাতন দিয়ে। প্রায়ই মনে হয়, ইশ! যদি আতঙ্ক ও নির্যাতনের এই স্মৃতিগুলো সত্য না হতো কিংবা মুছে ফেলতে পারতাম স্মৃতির মানসপট থেকে।